হযরত আলি (রা.)

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - আদর্শ জীবন চরিত | NCTB BOOK

হযরত আলি (রা.)

প্যানেল আলোচনা

'হযরত মুসা (আ.) এবং হযরত আলি (রা.)-এর জীবনাদর্শ চর্চা'

উল্লিখিত মহামানবদের জীবনাদর্শ তোমার জীবনে কীভাবে অনুশীলন করবে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তা তোমার সহপাঠীর সাথে প্যানেল বা দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো।

হযরত আলি (রা.) মহানবি (সা.)-এর জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা। তিনি আহলুল বায়ত বা নবি- পরিবারের অন্যতম সদস্য। তাঁর পিতা ছিলেন আবু তালিব, যিনি মহানবি (সা.)-এর আপন চাচা। তাঁর মা ফাতিমা বিনতে আসাদ, যিনি মহানবি (সা.)-এর কাছেও মাতৃতুল্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

হযরত আলি (রা.)-এর উপনাম আবুল হাসান ও আবু তুরাব। আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ), হায়দার (সিংহ), মুরতাজা (কবুলকৃত), আমিরুল মু'মিনিন (বিশ্বাসীদের নেতা) ইত্যাদি তাঁর উপাধি।

জন্ম ও শৈশব

হযরত আলি (রা.) মহানবি (সা.)-এর ওহি লাভের ১০ বছর পূর্বে এবং হিজরতের ২৩ বছর পূর্বে ৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম হাকিমসহ অনেক ঐতিহাসিকের মতে, তিনি কাবা শরিফের অভ্যন্তরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি শৈশব থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং খাদিজা (রা.)-এর সংসারেই লালিতপালিত হন। তিনি সব সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গেই থাকতেন।

ইসলাম গ্রহণ ও ইসলামের সেবায় অবদান

হযরত আলি (রা.) বালকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি যেহেতু রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর ঘরে লালিতপালিত হয়েছেন, সেহেতু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি কখনো মূর্তিপূজাসহ অনৈসলামিক কোনো কার্যকলাপে যুক্ত হননি।

মহানবি (সা.) তাঁর বাসায় কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সমবেত করে ইসলামের দাওয়াত দেন। আবু লাহাবের প্ররোচনায় তখন কুরাইশ নেতারা তাঁর আহ্বানে সাড়া দেননি। কিন্তু আলি (রা.) তখন দৃঢ় কণ্ঠে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তাঁর আনুগত্যের ঘোষণা দেন। হিজরতের রাতেও তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মক্কায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘরে তাঁরই বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন। জীবনের কঠিন ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রদত্ত আমানতের মালের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দেওয়া দায়িত্বের চেয়ে তিনি তাঁর জীবনের মূল্য তুচ্ছ মনে করেছেন। দায়িত্ব পালনেই ছিল তাঁর কাছে বড় ব্যাপার। কিছুদিন পর তিনি মদিনায় হিজরত করেন।

বীরত্ব

আলি (রা.) বদর যুদ্ধসহ প্রতিটি যুদ্ধে মহানবি (সা.)-এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। বদরের যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে যুলফিকার তলোয়ার উপহার দেন। সবগুলো যুদ্ধে তিনি পতাকা বহন করেছেন। শুধু তাবুক যুদ্ধে তিনি অংশ নিতে পারেননি। কারণ, এ সময় মহানবি (সা.) তাঁকে মদিনা নগরীর দায়িত্বভার দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিটি যুদ্ধে তিনি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। খায়বার যুদ্ধের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে পতাকা প্রদান করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তিনি ঢাল হারিয়ে ফেললে কামুস দুর্গের অত্যন্ত ভারী একটি দরজাকে ঢাল বানিয়ে যুদ্ধ করেন। পরবর্তীতে এই দরজা উঠাতে আটজন মানুষের সম্মিলিত শক্তির প্রয়োজন হয়েছিল। তাঁর এই অলৌকিক কীর্তিতে মুসলিমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে 'আসাদুল্লাহ' বা 'আল্লাহর সিংহ' উপাধি দান করেন।

আলি (রা.) একজন কাতিবে ওহি তথা ওহি লেখক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়ও তিনি সন্ধিপত্র লেখার দায়িত্ব পালন করেন।

বিবাহ

হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতিমা (রা.)-কে হযরত আলি (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহ দেন। এই পবিত্র সংসারে হযরত হাসান, হোসাইন, মুহসিন, যয়নব ও উম্মে কুলসুম জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালেই মুহসিন (রা.) ইন্তিকাল করেন।

পূর্ববর্তী খলিফাদের প্রতি আনুগত্য ও সহায়তা

হযরত আলি (রা.) তাঁর পূর্বে খলিফা হিসেবে হযরত আবু বকর (রা.), উমর (রা.) ও উসমান (রা.)-কে পেয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের খিলাফত আমলে তিনি তাঁদের প্রধান পরামর্শদাতার দায়িত্ব পালন করেন। উমর (রা.) এ জন্য বলেছিলেন, 'আলি না থাকলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত।' বিশেষ করে উসমান (রা.) শত্রুবেষ্টিত হলে তাঁকে প্রতিরক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালান। এ কাজে তিনি হযরত হাসান (রা.) ও হযরত হোসাইন (রা.)-কেও নিযুক্ত করেছিলেন।

খিলাফতের দায়িত্বলাভ

৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন খলিফা হযরত উসমান (রা.) শাহাদত বরণ করেন। এর কয়েক দিন পর বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবিদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত আলি (রা.) চতুর্থ খলিফা হিসেবে খিলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন। খিলাফতের দায়িত্ব লাভ করার পর উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীদের বিচার করা নিয়ে তিনি নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হন। সাহাবিগণের অনেকেই তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন। কিন্তু হত্যাকারীদের পরিচয় শনাক্ত করা না যাওয়ায় তাদের বিচার করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয় এবং ফলে রক্তক্ষয়ী উষ্ট্রের যুদ্ধ ও সিফফিনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরবর্তী সময়ে খারেজি নামক চরমপন্থীদের অভ্যুদয় ঘটে। তাদের বিরুদ্ধে হযরত আলি (রা.) নাহরাওয়ানের যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

জ্ঞানসাধনা

আরবে অল্প যে কয়েকজন মানুষ লেখাপড়া জানতেন, হযরত আলি (রা.) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্রের প্রবর্তক ছিলেন। তিনি ৫৮৬টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি অসাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। মহানবি (সা.) বলেছেন,

أَنَا دَارُ الْحِكْمَةِ وَعَلِيٌّ بَابُهَا

অর্থ: 'আমি প্রজ্ঞার ঘর আর আলি হলেন সে ঘরের দরজা।' (তিরমিযি)

চারিত্রিক গুণাবলি

হযরত আলি (রা.) জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, বিবেচনাবোধ, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, পরহেযগারিতা, দুনিয়াবিমুখতা ইত্যাদির সমন্বয়ে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একবার এক ইহুদি তাঁর বর্ম চুরি করে নিয়েছিল। কিন্তু তিনি উপযুক্ত প্রমাণ দিতে না পারায় তাঁরই নিযুক্ত বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে রায় দেয়। তিনিও রায় মেনে নেন। পরবর্তী সময় ইসলামের এই ন্যায়বিচার দেখে সেই ইহুদি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। সাধারণ মানের কাপড় পরতেন।

হযরত আলি (রা.)-এর সম্মান ও মর্যাদা

হযরত আলি (রা.) জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবির অন্যতম। হিজরতের পরে মহানবি (সা.) প্রত্যেক মুহাজির সাহাবির সঙ্গে একজন আনসার সাহাবিকে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন এবং নিজের জন্য আলি (রা.)-কে নির্বাচন করেছিলেন। হযরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে হযরত হারুন (আ.)-এর যে সম্পর্ক, আলি (রা.)- এর সঙ্গেও তাঁর তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন,  

مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ

অর্থ: 'আমি যার অভিভাবক, আলিও তাঁর অভিভাবক।' (তিরমিযি)

আরেকটি হাদিসে মহানবি (সা.) আলি (রা.)-কে বলেছেন, 'তুমি আমার এবং আমি তোমার।' (বুখারি)

হযরত আলি (রা.)-এর কয়েকটি উপদেশ

আলি (রা.) বলেছেন:

■ ধন-সম্পদের চেয়ে জ্ঞান উত্তম। কারণ, ধন-সম্পদ তোমার পাহারা দিতে হয় আর জ্ঞান নিজেই তোমাকে পাহারা দেবে। সম্পদ বিতরণ করলে শেষ হয়ে যাবে আর জ্ঞান যতই বিতরণ করবে, ততই বাড়বে। 

■ তোমার শত্রু তিনজন: তোমার নিজের শত্রু, তোমার শত্রুর বন্ধু এবং তোমার বন্ধুর শত্রু। 

■ দানশীলতা সর্বোত্তম গুণ।

ইন্তিকাল

হযরত আলি (রা) ৪০ হিজরির ১৮ রমযান শুক্রবার ফজরের নামাযে যাবার পথে খারেজি দুর্বৃত্ত আবদুর রহমান ইবনে মুলজিমের বিষাক্ত খঞ্জরের আঘাতে আহত হন। এর তিনদিন পর ২১ রমযান তিনি শাহাদাত বরণ করেন। হযরত হাসান (রা.) তাঁর জানাযা পড়ান। এরপর কুফার জামে মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

প্রতিফলন ডায়েরি লিখন 

হযরত আলি (রা.)-কে কেন আসাদুল্লাহ বলা হয়? 

(উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তুমি একটি প্রতিবেদন তৈরি করো। কাজটি করার জন্য তুমি তোমার পরিবারের সদস্য, সহপাঠী, ধর্মীয়জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি বা অনলাইন সোর্স এর সহায়তা নিতে পারো।)

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion